পবিত্র কুরআনের বক্তব্য
মহান আল্লাহ্ তায়ালা এরশাদ করেন-
والشمس والقمر بحسبان
অর্থাৎ “সূর্য ও চাঁদ উভয়েই সময়ের হিসেব নির্দেশক”। [(সূরাহ আর-রহমান-৫)]
সময়কে বিশ্লেষণ করলে আমরা সেকেন্ড, মিনিট, ঘন্টা, দিন-রাত, মাস ও বছর সময়ের এ ৬টি স্তরের অস্তিত্ব খুজে পাই। সূর্য ও চাঁদ উভয়েই সময়ের উল্লেখিত কোন না কোন স্তরের নির্দেশক।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে সূর্য ও চাঁদ এর কোনটি সময়ের উল্লেখিত স্তরগুলোর কোন কোন স্তরের নির্দেশক? এ বিষয়ে গবেষণার ফলাফলে জানা যায় সূর্য সময়ের উল্লেখিত ৬টি স্তরের প্রতিটিরই নির্দেশক। অর্থাৎ সূর্যের পরিভ্রমণের মাধ্যমে সেকেন্ড, মিনিট, ঘন্টা, দিন-রাত, মাস ও বছরের হিসেব নির্ধারণ করা হয়। পক্ষান্তরে চাঁদ শুরু ও শেষ হওয়ার মাধ্যমে শুধুমাত্র বছর ও মাসের হিসেব নির্ধারিত হয়। কিন্তু চাঁদের শুরু-শেষ, পূর্ণতা ও ক্ষয়ের সঙ্গে সেকেন্ড, মিনিট, ঘন্টা এবং দিবা-রাত্রির আগমণ-প্রস্থানের কোন সম্পর্ক নেই। পবিত্র কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াতের দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয়। এরশাদ হচ্ছে-
-هوالذى جعل الشمس ضياء والقمر نورا وقدره منازل لتعلموا عدد السنين والحساب
অর্থাৎ “তিনি আল্লাহ্ যিনি সূর্যকে করেছেন প্রখরতাপূর্ণ আলো আর চাঁদকে করেছেন স্নিগ্ধময় আলো। আর চাঁদের জন্য নির্ধারণ করেছেন অনেক গুলো মানযিল। (২৯দিনে ২৯টি উদয় ও অস্তস্থল) যাতে তোমরা জানতে পার বছরের সংখ্যা ও (তারিখের) হিসাব”। [(সূরাহ ইউনূস, আয়াত-৫)]
শ্রদ্ধেয় ড. মুফতী মাওলানা এ. কে. এম. মাহবুবুর রহমান সাহেব এই আয়াতের ব্যাখ্যা এভাবে করেছেন – “অত্র আয়াতে কারীমায় ‘বছর’ কথাটি স্পষ্ট উল্লেখ থাকলেও ‘মাস’ কথাটি স্পষ্ট উল্লেখ না করে বরং তাকে حساب শব্দে রূপকভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ চান্দ্র বছর হয় সুনির্দিষ্ট ১২টি চন্দ্র মাস অথবা ৩৫৪দিনের সমন্বয়ে। এতে কোন কম বেশী হয়না। কিন্তু চান্দ্র মাস গুলো সুনির্দিষ্ট সংখ্যক দিন নিয়ে গঠিত নয়। বরং কোন মাস ২৯দিনে আবার কোন মাস ৩০দিনে হয়। অন্যদিকে এবছর যে চান্দ্র মাসটি ৩০দিনে হবে, আগামী বছর সে মাসটি ৩০দিনে হতে পারে, আবার ২৯দিনেও হতে পারে। কিন্তু মাস বলতে সুনির্দিষ্ট ৩০দিনকেই বুঝায়। এ কারণেই মহাবিজ্ঞ মহান রব্বুল আলামীন অত্র আয়াতে চান্দ্র মাসকে شهر বা মাস না বলে حساب বলে উল্লেখ করেছেন। অতএব পবিত্র কুরআনের মাধ্যমে প্রমাণিত যে, ‘চাঁদ শুধুমাত্র মাস ও বছরের সময় অর্থাৎ তারিখ নির্দেশক’।” সূর্যের সঙ্গে সম্পর্কিত সময়ের প্রথম ৪টি স্তর সেকেন্ড, মিনিট, ঘন্টা ও দিন-রাত স্থানীয়ভাবে স্থানীয় মানুষের জন্য প্রযোজ্য হলেও চাঁদ এর সাথে সম্পর্কিত সময়ের ২টি স্তর মাস ও বছর সামগ্রিকভাবে বিশ্ববাসীর জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য।
আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেন,
-يسئلونك عن الاهلة قل هى مواقيت للناس والحج
অর্থাৎ “(হে রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তারা আপনাকে নতুন চাঁদ সমূহ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। আপনি বলে দিন তা মানুষের জন্য সময়ের (তারিখ) নির্দেশক এবং হজ্জের (সময় অর্থাৎ তারিখ নির্ধারণকারী)”। [(সূরা আল-বাকারা, আয়াত-১৮৯)]
বিশেষ ভাবে লক্ষ্যণীয় এই আয়াতে “الاهلة” শব্দ উল্লেখ করা হয়েছে যার অর্থ একেবারে (কয়েক মিনিটের) “নতুন চাঁদ সমূহ”। প্রতি চান্দ্র মাসে চাঁদ একদিনই নতুন থাকে। তারপরের দিনগুলোর চাঁদ কখনো নতুন চাঁদ হতে পারেনা।এখানে আরো লক্ষ্য করার বিষয় এই যে, এই আয়াতের মধ্যে “للناس” শব্দের শুরুতে “ال” টি “الف لام جنسى” অর্থাৎ “জাতি বোধক ال” (ইংরেজিতে অর্থ “The” এবং এটা Common Noun) । অতএব “للناس” অর্থ হলো “মানুষের জন্য” বা “মানব জাতির জন্য”। আর সময় বলে এই আয়াতে তারিখ বুঝানো হয়েছে। তাহলে আয়াতের ব্যাখ্যা হচ্ছে “পূর্ববর্তী চান্দ্র মাস শেষ হওয়ার পর পুনরায় নতুন করে পৃথিবীর আকাশে সর্বপ্রথম যে চাঁদ দেখা যায়, সেই নতুন চাঁদ বিশ্বের সকল মানুষের জন্যই তারিখ নির্ধারক এবং হজ্জ্বের তারিখ নির্ধারক”। সুতরাং নতুন চাঁদ নির্দেশিত এই নতুন মাসের ১ তারিখ এলাকা, দেশ, মহাদেশের ভিন্নতায় কখনই আলাদা হবে না। কারণ “নতুন চাঁদ” উদয়ের দিনে সকল এলাকা, দেশ, মহাদেশের বাসিন্দারাই “মানুষ” ছিলেন, আছেন, থাকবেন। আর মহাপবিত্র কুরআন বলছে- “তা ( অর্থাৎ নতুন চাঁদ সমূহ) মানুষের জন্য (বা মানব জাতির জন্য) সময় (তারিখ) নির্ধারক”।
রোযা রাখা কার উপর ফরয তার সিদ্ধান্ত দিয়ে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা এরশাদ করেন-
-فمن شهد منكم الشهر فليصمه
অর্থাৎ “তোমাদের যে কেউ এ (পবিত্র রমযান) মাস পাবে সেই যেন তাতে (এ মাসে) রোযা রাখে।” [(সূরাহ আল বাকারাহ-১৮৫)]
এই আয়াতের দ্বারা রমযান মাসের রোযা ফরয করা হয়েছে। আর রোযা ফরয হওয়ার কারণ নির্ধারন করা হয়েছে “শুহুদে শাহার” বা রমযান মাস পাওয়াকে। অর্থাৎ যে ব্যক্তি রোযা রাখার যাবতীয় সামর্থ সহকারে পবিত্র রমযান মাসে উপস্থিত হবে তার জন্যই রমযানের রোযা রাখা ফরয। এই আয়াতে উল্লেখিত “مَنْ” (অর্থাৎ “যে কেউ”) শব্দটি দেশ মহাদেশ নির্বিশেষে “عام” বা ব্যাপক অর্থ বোধক। তাই এই শব্দকে দেশ মহাদেশের সীমারেখায় সীমিত করা উছুলে তাফসীরের মূলনীতি পরিপন্থি। অতএব এই আয়াতে “مَنْ” (যে কেউ) শব্দটির মাধ্যমে ব্যাপকার্থে সমগ্র পৃথিবীর যে কোন মুসলিম সম্বোধিত।
এ থেকে বুঝা যায়, আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা রোযা ফরয হওয়ার কারণ নির্ধারণ করেছেন রমজান মাসের উপস্থিতিকে। আর মাসের উপস্থিতি প্রমাণিত হয় নতুন চাঁদ উদয়ের মাধ্যমে। অর্থাৎ পৃথিবীর আকাশে কোথাও রমজান এর নতুন চাঁদ দেখা গেলেই মানব জাতির জন্য বা সমগ্র পৃথিবীর মানুষের জন্য রমজান মাসের উপস্থিতি প্রমাণিত হবে। আর মাসের উপস্থিতি প্রমাণিত হলে সকল মুসলিমের উপর ঐদিন থেকেই রোযা রাখা ফরয হবে।
এ ব্যাপারে তাফসীর শাস্ত্রের ইমাম ফখরুদ্দিন রাযী (রঃ) তাফসীরে কাবীরে উল্লেখ করেছেন-
“যে ব্যক্তি এ পবিত্র রমযান মাসে উপনিত হবে এ মাস সম্পর্কে তার জ্ঞান ও আকলের মাধ্যমে তার উপরই রোযা রাখা জরুরী”। (ইমাম রাযীর কথা এপর্যন্তই এখানে দেয়া হল) [(তাফসীরে কাবীর, খন্ড-২, পৃঃ-২৫৫)]
মাসের উপস্থিতি কিভাবে প্রমাণিত হবে? এ প্রশ্নের জবাবে ইমাম রাযী (রঃ) লিখেছেন-
“পবিত্র রমযান মাসের উপস্থিতি কি ভাবে প্রমাণিত হবে? এর জবাবে আমরা বলবো মাস প্রমাণিত হবে নতুন চাঁদ দেখা বা তার সংবাদ শোনার মাধ্যমে”। (ইমাম রাযীর কথা এপর্যন্তই এখানে দেয়া হল) [(তাফসীরে কাবীর, খন্ড-২ পৃঃ-২৫৬)]
এ প্রসংগে ইমাম রাযী (রঃ) আরও লিখেছেন-
“দুইজন সত্যবাদী ন্যায় পরায়ণ ব্যক্তির চাঁদ দেখার সাক্ষ্য শ্রবণের মাধ্যমেই সকলের প্রতি রোযা রাখা ও ছাড়ার হুকুম প্রযোজ্য হবে”। (ইমাম রাযীর কথা এপর্যন্তই এখানে দেয়া হল) [(তাফসীরে কাবীর, খন্ড-২ পৃঃ-২৫৬)]
এই কথার দলীল হচ্ছে এই হাদীস
আব্দুর রহমান ইবনে যায়েদ (রা.) থেকে বর্ণিত, নিশ্চয়ই রসূলুল্লাহ্ (দ.) বলেছেন, “...যদি (মুসলিমদের) দু’জন স্বাক্ষ্য দেয় যে, তারা (নতুন চাঁদ উদয়ের ব্যাপারে) দেখেছে, তাহলে তোমরা সাওম (রোজা) ও ঈদ পালন কর।” [নাসাঈ, সহীহ্, অধ্যায়ঃ ৮, হাদিস # ২১১৬।]
তাফসীরে রুহুল মাআনীতে আল্লামা আলুসী রহমাতুল্লাহি আলাইহি লিখেছেন,
“মাস উপস্থিতির অর্থ হলো যে মুসাফির নয় তাকে রোযা রাখতে হবে অথবা যে ব্যক্তি পবিত্র রমযান মাসের নতুন চাঁদ উদয়ের সংবাদ পেল এবং তাকে বিশ্বাস করল, তার উপরই রোযা রাখা ফরয”। (আল্লামা আলুসীর কথা এপর্যন্তই এখানে দেয়া হল) [(তাফসীরে রুহুল মায়ানী, খন্ড-২, পৃঃ-৬১)]
তাফসীরে বায়জাবী শরীফে বলা হয়েছে-
-يثبت شهود هذا الشهر برؤية البصر او بالسماع
অর্থাৎ “নতুন চাঁদ দেখা বা চাঁদ উদয়ের সংবাদ শুনার দ্বারাই মাস প্রমাণিত হবে”। (তাফসীরে বায়জাবীর উদ্ধৃতি এপর্যন্তই এখানে দেয়া হল) [(তাফসীরে বায়জাবী শরীফ)]
উপরোক্ত তাফসীর থেকে বুঝা যায় পবিত্র রমযান মাস প্রমাণিত হওয়ার জন্য “সকলকে” এবং “নিজ দেশের সীমায়” চাঁদ দেখতে হবেনা বরং সমগ্র পৃথিবীর কোথাও রমজান এর নতুন চাঁদ দেখা গেলে, চাঁদ দেখা বা চাঁদ উদয়ের গ্রহনযোগ্য সংবাদ শুনার দ্বারা মানব জাতির জন্য বা সমগ্র পৃথিবীর মানুষের জন্য রমজান মাসের উপস্থিতি প্রমাণিত হবে। আর রমজান মাসের উপস্থিতি প্রমাণিত হলে পৃথিবীর সকল মুসলিমের উপর ঐদিন থেকেই রোযা রাখা ফরয হবে।
পবিত্র কুরআন বিশ্বজনীন গ্রন্থ।সুতরাং, এর প্রতিটি হুকুমই বিশ্বজনীন। তাই এর কোন হুকুমই দেশ মহাদেশের সীমারেখায় সীমিত নয়। রোযা রাখা ও ঈদ করার জন্য নিজ নিজ দেশে চাঁদ দেখতে হবে এ রকম বর্ণনা পবিত্র কুরআনের কোথাও নেই। তদুপরি যখন পবিত্র কুরআন নাযিল হয়েছিল তখন তো বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান নামে বিশ্বে কোন দেশই ছিলনা, তাহলে হারাম জাতিয়তাবাদী ভৌগলিক সীমারেখার মধ্যেই চাঁদ দেখা যেতে হবে এ কথা পবিত্র কুরআনের বাণীর সঙ্গে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক।
|