বৃটেন ও কানাডার সমস্যা এবং মুফতি বৃন্দের ফাতওয়া
বৃটেনের সমস্যা ও মুফতি বৃন্দের ফাতওয়া
বৃটেনের আবহাওয়া মেঘাচ্ছন্ন থাকার কারনে রোজা এবং ঈদ উদযাপনের সময় প্রতি বছর এক অস্বস্তিকর পরিবেশের সৃষ্টি হয়। গত ৪০ বছরের অধিক সময় ধরে এই বিভেদ চলে আসছে। কেউ মরক্কোর সাথে, কেউ পাকিস্তানের সাথে আর কেউ সৌদির সাথে রোজা – ঈদ করাকে সঠিক বলে মনে করেন। প্রত্যেকেই আবার নিজস্ব যুক্তিতে অটল আছেন। ফলে মতভেদ ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ষাটের দশকে তখনকার কিছু উলামারা পরামর্শ দেন নিকটতম মুসলিম দেশ হিসেবে মরক্কোকে অনুসরণ করতে। সেই অনুযায়ী ১৯৬৬ থেকে বৃটেনের বেশিরভাগ মুসলিম মরক্কোকে অনুসরণ করছিলেন। কিন্তু তা রহিত হয় ১৯৮৬ সালে। ঐ বছর চাঁদ দেখা বিষয় একটি জটিল আকার ধারণ করে। ২৯ রোজার সময় সারা রাত চলে গেলেও মরক্কো থেকে চাঁদ দেখার কোন সংবাদ আসেনি। পরবর্তি দিন রোজা ভেবে সবাই সেহরী খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। সকালে যখন সবাই নিজ নিজ কাজে চলে যান, তখন আনুমানিক ১১ টার সময় মরক্কো থেকে খবর আসে যে ঐখানে ঈদ হচ্ছে। বৃটেনে শুরু হয়ে যায় এক হুলুস্থুল কান্ড। কেউ রোজা ভেঙ্গে দেন আর কেউ তা চালিয়ে যান। যারা রোজা ভেঙ্গে দেন তারা কিন্তু সেদিন ঈদের নামাজ পড়তে পারেননি। কারন সংবাদের সত্যতা যাচাই করতে করতে প্রায় ১ টা বেজে যায়। শুরু হয় পারস্পরিক ভুল বুঝাবুঝি এবং কাঁদা ছুড়াছুড়ি। উলামাগন এই পরিস্থিতি হতে উত্তরনের লক্ষে জরুরী বৈঠকে বসেন।
সম্মানিত উলামায়ে কিরাম দীর্ঘ আলোচনার পর একমত হন যে, ভারত, পাকিস্তান সহ দুনিয়ার মুফতিদের কাছে এ মর্মে ফাতওয়া চাওয়া হোক। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তাদের বরাবর সমস্ত বিষয় অবহিত করে চিঠি লেখা হল। এতে লেখা হল, “বৃটেনের আবহাওয়া একাধারে কয়েকমাস যাবৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকার কারনে চাঁদ দেখা সম্ভব হয়না। যার কারনে রোজা ও ঈদের সময় এক নাজুক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। উলামাদের পরামর্শক্রমে আমরা বৃটেনবাসীরা নিকটতম প্রতিবেশী দেশ হিসেবে মরক্কোর সাথে রোজা ও ঈদ করে আসছি। যা ১৯৬৬ থেকে ১৯৮৬ পর্যন্ত অব্যাহত আছে। এখন নতুন সমস্যার উদ্ভব হয়েছে। মরক্কো হতে সময়মত খবর আসেনা। যদ্দরুন আমাদের এখানে অস্বস্তিকর অবস্থার সৃষ্টি হয়। যা হানাহানিতে রূপান্তরিত হয়েছে। এ সমস্যা হবেনা যদি আমরা সৌদি আরবের সাথে রোজা ও ঈদ করি। এর কি কোনো সুযোগ আছে? এ সম্পর্কে আপনাদের দিক নির্দেশনা আমাদের জন্য খুবই জরুরী। অনুগ্রহ করে আপনাদের মূল্যবান ফাতওয়া প্রদানে আমাদেরকে বাধিত করবেন”।
এই চিঠির জবাবে সম্মানিত মুফতিবৃন্দ যে সমস্ত ফাতওয়া দেন তার কয়েকটি এখানে উল্লেখ করা হল:
ভারতের বালছার জেলার জামেয়া ঢাবেলের দারুল ইফতার প্রধান মুফতি আহমাদ খানপুরী তার প্রদত্ত ফাতওয়ায় লিখেছেন,
“ইমাম আবু হানিফা, ইত্তেহাদুল মাতালি (উদয়স্থলের অভিন্নতা বা Global moon sighting) এর পক্ষে। অর্থাৎ দূরবর্তী স্থান থেকে সংবাদ আসলে স্থানীয়ভাবে তা আর দেখার প্রয়োজন নেই। এটাকে সবাই সমর্থন করুন। এমনকি পূর্ব পশ্চিমের বেলায়ও তা প্রযোজ্য। অর্থাৎ যদি দুনিয়ার পশ্চিমে চাঁদ দেখা যায় আর নির্ভরযোগ্য সূত্রে তা পূর্ববাসীদের কাছে পৌঁছে যায়, তবে পূর্ববাসীদর জন্যও রোজা রাখা ফরজ হয়ে যাবে (দেখুন, দুররে মুখতার, ফাতওয়ায়ে রশীদিয়া, ফাতওয়ায়ে দারুল উলুম দেওবন্দ, ইমদাদুল ফাতওয়া, কেফায়াতুল মুফতি প্রভৃতি)”। (মুফতি আহমাদ খানপুরী সাহেবের ফতওয়া এপর্যন্তই এখানে দেয়া হল)
ভারতের সাহরানপুরের মাজাহিরুল উলুম থেকে হযরত মুফতি ইহাইয়া তার প্রদত্ত ফাতওয়ায় লিখেছেন,
“আপনারা সৌদি আরবের ঘোষণাকে মেনে নিতে পারেন। চাঁদ দেখার বিষয়ে তারা অত্যন্ত সচেতন এবং নির্ভরযোগ্য।” (মুফতি ইহাইয়া সাহেবের ফতওয়া এপর্যন্তই এখানে দেয়া হল)
কানাডার সমস্যা ও মুফতি বৃন্দের ফাতওয়া
কানাডায় ঐ একই সমস্যা চাঁদ দেখা বিতর্কের সমাধানের লক্ষ্যে সম্মানিত উলামায়ে কিরাম প্রতি মাসের প্রথম চাঁদ বিশ্বের যে কোন দেশে দেখার নির্ভরযোগ্য সংবাদ গ্রহন (Global moon sighting বা ইত্তিহাদুল মাতালি) এর সিদ্ধান্ত করেন এবং এ ব্যাপারে নিম্নোক্ত উলামারা সাক্ষর করেন
(১) ইমাম ড. আব্দুল্লাহ হাকিম
(২) ইমাম ড. হামিদ সিলমী
(৩) ইমাম ড. এম ইকবাল আল নদভী
(৪) ইমাম ড. সাঈদ ফাইজী
(৫) ইমাম শাইখ ফাইজানুল হক
(৬) ইমাম আব্দুল হাই প্যাটেল
(৭) ইমাম উমার সুবেদার
(৮) ইমাম আয়ূব মামুন
(৯) শাইখ সাইয়েদ শাহ মুহাম্মদ কাদরী
(১০) ইমাম ইউসুফ বাদাত
তারাও বিশ্বের বিভিন্ন মাদ্রাসায় ফতওয়া চান। নিম্নে ফাতওয়াগুলি দিয়ে দেয়া হল।
(১) দক্ষিণ আফ্রিকার দারুল উলুম জাকারিয়ার দারুল ইফতা থেকে মুফতি রিজাউল হক ও মুফতি ইলিয়াস শাইখ যে ফাতওয়া প্রদান করেছেন তা দেখতে নিম্নোক্ত লিংকে ক্লীক করুন।
http://crescentcommittee.ca/wp-content/uploads/2012/07/Adopting-Global-Sighting-for-the-Sake-of-Unity-in-Canada-Mufti-Rada.pdf
(২) হায়দারাবাদের মাহাদ আল আলি আল ইসলামী থেকে মুফতি খালিদ সাইফুল্লাহ আল রাহমানী সাহেবের ফাতওয়া দেখতে নিম্নোক্ত লিংকে ক্লীক করুন।
http://crescentcommittee.ca/wp-content/uploads/2012/07/Global-Sighting-for-Unity-by-Mufti-Khalid-Saifullah-Al-Rahmani.pdf
(৩) দারুল ইফতা নদওয়াতুল উলামা এর ফাতওয়া দেখতে নিম্নোক্ত লিংকে ক্লীক করুন।:
http://crescentcommittee.ca/wp-content/uploads/2012/07/Global-Sighting-Fatwa-Nadwatul-Ulama-4-April-2013.pdf
(৪) মাজাহিরুল উলুম সাহারানপুর এর ফাতওয়া দেখতে নিম্নোক্ত লিংকে ক্লীক করুন।
http://crescentcommittee.ca/wp-content/uploads/2012/07/Global-Sighting-Fatwa-Saharanpur.pdf
৫) পাকিস্তানের মুফতিয়ে আজম রফী উসমানী সাহেবের ফাতওয়া দেখতে নিম্নোক্ত লিংকে ক্লীক করুন।
http://crescentcommittee.ca/wp-content/uploads/2012/07/Mufti-Rafi-Usmani-on-Global-Sighting-for-Canada-Fatwa.pdf
পাঠকবৃন্দের সুবিধার্থে এখানে দুটি ফাতওয়ার কিছু অংশের অনুবাদ করে দিচ্ছি।
(১) দক্ষিণ আফ্রিকার দারুল উলুম জাকারিয়ার দারুল ইফতা থেকে মুফতি রিজাউল হক ও মুফতি ইলিয়াস শাইখ সাহেবের দেয়া ফাতওয়া এর কিছু অংশের অনুবাদ:
“প্রধানত শক্তিশালী মতামত (জাহির আল রিওয়ায়াত বা predominantly strong view) এর মূল কথা অনুযায়ী কানাডার মানুষ কাছের বা দূরের দেশের চাঁদ দেখার নির্ভরযোগ্য সাক্ষ্য গ্রহন করতে পারে। এর জন্য আপনাদের মত জ্ঞানী মানুষদের কাছে শরীয়াহ এর প্রমানাদির তালিকা দেয়ার প্রয়োজন নেই, যেখানে প্রমানাদি আপনাদের সামনে সুস্পষ্ট। তারপরও আমরা সামান্য কিছু এখানে দিচ্ছি।
“শামসুল আইম্মা ইমাম আল হালওয়ানী (রঃ) এর মতে চাঁদের উদয়স্হলের ভিন্নতা বিবেচ্য নয়” (উদ্ধৃতি এপর্যন্তই এখানে দেয়া হল) [(শরহে তুহফাত আল মুলুক লি মুহাম্মদ বিন আব্দুল লতিফ আল মারুফ বি ইবনে আল মালাক, খন্ড ২, পৃষ্ঠা ১২৬৪)]
মাজমা উল আনহারে লিখিত হয়েছে, “এটাই মাজহাব এবং এর উপরেই ফাতওয়া” (উদ্ধৃতি এপর্যন্তই এখানে দেয়া হল) [(মাজমা উল আনহার খন্ড ১, পৃষ্ঠা ২৯১)]
“যদি চাঁদ দেখার সংবাদ সঠিক পদ্ধতিতে প্রতীয়মান হয় তবে পশ্চিম অঞ্চলের মানুষের চাঁদ দেখা (অনুযায়ী আমল করা) পূর্ব অঞ্চলের মানুষের জন্য বাধ্যতামূলকভাবে প্রযোজ্য”। (উদ্ধৃতি এপর্যন্তই এখানে দেয়া হল) [(আত তাহতাবী আলা আদ্দূর, খন্ড ১, পৃষ্ঠা ৪৪৯)]
এই দৃষ্টিকোন থেকে নিশ্চয়ই আপনারা কাছের অথবা দূরের দেশের সঠিক সংবাদ গ্রহন করে সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন”। (মুফতি রিজাউল হক ও মুফতি ইলিয়াস শাইখের দেয়া ফাতওয়ার উদ্ধৃতি এপর্যন্তই এখানে অনুবাদ করে দেয়া হল)
(২) হায়দারাবাদের মাহাদ আল আলি আল ইসলামী থেকে মুফতি খালিদ সাইফুল্লাহ আল রাহমানী সাহেবের দেয়া ফাতওয়া এর কিছু অংশের অনুবাদ:
“কোথাও নতুন চাঁদ দেখা গেলে তা পুরো বিশ্বের জন্য যথেষ্ঠ। এটাই অধিকাংশ (জমহুর) স্কলারদের (উলামা ও ফকীহদের) মতামত
“অধিকাংশ (জমহুর) ফকীহদের মতামত হচ্ছে চাঁদের উদয়স্হলের ভিন্নতা (অর্থাৎ স্হানীয় ভাবে প্রত্যেক জায়গায় আলাদা চাঁদের হিসাব) গ্রহনীয় নয়” (উদ্ধৃতি এপর্যন্তই এখানে দেয়া হল) [(আল মাউজু আল ফিকহিয়্যা, পৃষ্ঠ ৩৫)]
এটাই (ফিকাহ শাস্ত্রের ইমাম) ইমাম আবু হানীফা (রঃ) এর প্রধান মতামত। (ফিকাহ শাস্ত্রের ইমাম) ইমাম হাছকাফী, ইমাম নাসাফী এবং ইমাম নুজাইম আল মাসরী এর বর্ণনা দিয়ে লিখিত হয়েছে,
“চাঁদের উদয় স্হলের ভিন্নতা বিবেচ্য নয়। সুতরাং যদি এক শহরের মানুষ চাঁদ দেখে, যখন অন্য শহরের মানুষ চাঁদ দেখেনি, এমতাবস্হায় চাঁদ দেখার সংবাদটি সঠিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হলে যারা চাঁদ দেখেছে তাদের কারনে অন্যদের রোযা রাখা জরুরী হবে । সুতরাং পশ্চিমের অধিবাসীদের চাঁদ দেখা পূর্বের অধিবাসীদের জন্যও প্রযোজ্য হবে”। (উদ্ধৃতি এপর্যন্তই এখানে দেয়া হল) [(রদ্দুল মুহতার, খন্ড ৩, পৃষ্ঠা ৩৬৩, ৩৬৪) (দুর্রুল মুখতার, পৃষ্ঠা ১৪৩-১৪৫)]"
(মুফতি খালিদ সাইফুল্লাহ আল রাহমানী সাহেবের দেয়া ফাতওয়ার উদ্ধৃতি এপর্যন্তই এখানে অনুবাদ করে দেয়া হল)
|